https://nabajagoron.com/?p=821

প্রিয়তমাকে লেখা বীরশ্রেষ্ঠ মতিউরের শেষ চিঠি

https://nabajagoron.com/?p=821
https://nabajagoron.com/?p=821

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে চরম সাহসিকতা আর অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ যে ৭জন বীর মুক্তিযুদ্ধাকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান “বীর শ্রেষ্ঠ” উপাধিতে ভূষিত করা হয় তাদের অন্যতম হলেন বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান। মতিউর রহমান ১৯৬১ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের শুরুতে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে মতিউর রহমান সপরিবারে ঢাকায় দুই মাসের ছুটিতে আসেন। ২৫শে মার্চ কালরাতে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে, পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট থাকলেও দেশপ্রেমে আকুল হয়ে  অসীম ঝুঁকি ও সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করতে আসা বাঙালি যুবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য একটি ট্রেনিং ক্যাম্প খুললেন৷ 

১৯৭১ সালের ৯ই মে মতিউর রহমান ছুটি শেষ করে নিজ কর্মস্থল পাকিস্তানের করাচি ফিরে যান ৷ সেখানে ফিরে তিনি জঙ্গি বিমান দখল এবং সেটা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। পরিকল্পনানুসারে ১৯৭১ সালের ২০ই আগষ্ট টি-৩৩ নামক যুদ্ধবিমানটি শিক্ষানবীশ একজন পাইলটের উড্ডয়নের সময় রানওয়ে থেকে ছিনতাই করার চেষ্টা করেন। তিনি পরিকল্পনা করেন যে, পাইলট কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে উড্ডয়নের  ক্লিয়ারেন্স  পেলে তখন তিনি তার কাছ থেকে বিমানটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সোজা বাংলাদেশের আকাশে উড়াল দিবেন। পরিকল্পনা অনুসারে একজন সেফটি অফিসার হিসেবে তিনি রানওয়েতে অবস্থান নেন। কন্ট্রোল টাওয়ার ক্লিয়ারেন্সের পর পাইলট বিমানটি নিয়ে রানওয়েতে উড্ডয়নের প্রস্তুতি নিলে তিনি সেফটি অফিসারের ক্ষমতাবলে বিমানটি থামাতে বলে ককপিটে চড়ে বসেন এবং পাইলটকে  ক্লোরোফর্ম দিয়ে অচেতন করে ফেলেন। কিন্তু ভাগ্য প্রসন্ন হয়নি! জ্ঞান হারানোর আগে  পাইলট কন্ট্রোল রুমে জানাতে সক্ষম হন। প্রায় ভারতের সীমান্তে পৌঁছানোর পর তিনি টি-৩৩ যুদ্ধবিমানটিসহ তিনি বিধ্বস্ত হন। তার মৃতদেহ ঘটনাস্থল হতে প্রায় আধ মাইল দূরে পাওয়া যায়। বাংলাদেশ সরকার মতিউর রহমানকে তার সাহসী ভূমিকার জন্য বীর শ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করে ।

পিয়তমার প্রতি বীরশ্রেষ্ঠ মতিউরের শেষ চিঠি

প্রিয়তমা মিলি,
একটা চুম্বন তোমার পাওনা রয়ে গেলো, সকালে প্যারেডে যাবার আগে তোমাকে চুমু খেয়ে বের না হলে আমার দিন ভালো যায় না । আজ তোমাকে চুমু খাওয়া হয়নি । আজকের দিনটা কেমন যাবে জানিনা, এই চিঠি যখন তুমি পড়ছো, আমি তখন তোমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে । ঠিক কতটা দূরে আমি জানি না ।
মিলি, তোমার কি আমাদের বাসর রাতের কথা মনে আছে? কিছুই বুঝে উঠার আগে বিয়েটা হয়ে গেলো । বাসর রাতে তুমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে যখন কাঁদছিলে, আমি তখন তোমার হাতে একটা কাঠের বাক্স ধরিয়ে দিলাম । তুমি বাক্সটা খুললে, সাথে সাথে বাক্স থেকে ঝাকে ঝাকে জোনাকি বের হয়ে সারা ঘরময় ছড়িয়ে গেলো । মনে হচ্ছিলো আমাদের ঘরটা একটা আকাশ, আর জোনাকিরা তারার ফুল ফুটিয়েছে!
কান্না থামিয়ে তুমি নির্বাক হয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলে, “আপনি এত পাগল কেনো!?”
মিলি, আমি আসলেই পাগল, নইলে তোমাদের এভাবে রেখে যেতে পারতাম না । মিলি, আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দিন প্রিয় কন্যা মাহিনের জন্মের দিনটা । তুমি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলে । বাইরে আকাশ ভাঙা বৃষ্টি, আমি বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে কষ্টে পুড়ে যাচ্ছি । অনেকক্ষণ পরে প্রিয় কন্যার আরাধ্য কান্নার শব্দ । আমার হাতের মুঠোয় প্রিয় কন্যার হাত! এরপর আমাদের সংসারে এলো আরেকটি ছোট্ট পরী তুহিন ।
মিলি, তুমি কি জানো, আমি যখন আমার প্রিয় কলিজার টুকরো দুই কন্যাকে এক সাথে দোলনায় দোল খেতে দেখি, আমার সমস্ত কষ্ট -সমস্ত যন্ত্রণা উবে যায় । তুমি কি কখনো খেয়াল করেছো, আমার কন্যাদের শরীরে আমার শরীরের সূক্ষ্ম একটা ঘ্রাণ পাওয়া যায়? মিলি, আমাকে ক্ষমা করে দিও ।
আমার কন্যারা যদি কখনো জিজ্ঞেস করে, “বাবা কেন আমাদের ফেলে চলে গেছে?” তুমি তাদের বলবে, “তোমাদের বাবা তোমাদের অন্য এক মা’র টানে চলে গেছে, যে মা’কে তোমরা কখনো দেখোনি । সে মা’র নাম “বাংলাদেশ” । মিলি, আমি দেশের ডাককে উপেক্ষা করতে পারিনি । আমি দেশের জন্য আজকে ছুটে না গেলে আমার মানব জন্মের জন্য সত্যিই কলঙ্ক হবে । আমি তোমাদের যেমন ভালোবাসি, তেমনি ভালোবাসি আমাকে জন্ম দেওয়া দেশটিকে । যে দেশের প্রতিটা ধূলিকণা আমার চেনা । আমি জানি, সে দেশের নদীর স্রোত কেমন । একটি পুঁটি মাছের হৃৎপিণ্ড কতটা লাল । ধানক্ষেতে বাতাস কিভাবে দোল খেয়ে যায় ।
এই দেশটাকে হানাদাররা গিলে খাবে, এটা আমি কি করে মেনে নিই? আমার মায়ের আচল শত্রুরা ছিড়ে নেবে, এটা আমি সহ্য করি কিভাবে মিলি?
আমি আবার ফিরবো মিলি । আমাদের স্বাধীনতার পতাকা বুক পকেটে নিয়ে ফিরবো ।
আমি, তুমি, মাহিন ও তুহিন, বিজয়ের দিনে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়াবো সবাই । তোমাদের ছেড়ে যেতে বুকের বামপাশে প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে । আমার মানিব্যাগে আমাদের পরিবারের ছবিটা উজ্জ্বল আছে । বেশি কষ্ট হলে খুলে দেখবো বারবার ।
ভালো থেকো মিলি । ফের দেখা হবে । আমার দুই নয়ণের মণিকে অনেক অনেক আদর ।
                ইতি,
                  মতিউর 
              ২০শে আগস্ট, শুক্রবার, ১৯৭১ ৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *