সিনেমাপ্রেমী থেকে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার গল্প

ফাইল ছবি
সিনেমা-মুভিতে নায়ক-হিরোদের আনাগোনা প্রচুর লক্ষণীয় হলেও বাস্তব জীবনে প্রকৃত হিরো হওয়া সাধনার  বিষয়। আবার কেউ কেউ ক্যামেরার সামনে বাঘের হুংকার ছেড়ে  হিরো সাজলেও বাস্তব জীবনে দেখা যায় বিড়ালেও মতো মিও মিও অবস্থা। কিন্তু এমনি হাজারো ন্যাকা বিড়ালের ভিড়েও  আমরা কিছু সত্যিকার হিরোদের সাক্ষাত পাই। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন বাংলাদেশ জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির মিলন স্যার।

ব্যাক্তিগত ও সামাজিক জীবনের পাশাপাশি চাকুরী জীবনেও যিনি একজন দুর্দমনীয় বীর তিনি এই মিলন স্যার। অন্যায়ের কালো হাত দুমড়ে-মুচড়ে দেওয়ার কারণে  তাঁকে বারবার এক মন্ত্রনালয় থেকে অন্য মন্ত্রনালয়ে ওএসডি হতে হয়েছে। কিন্তু তারপরও থেমে নেই তাঁর এই অন্যায়ের যুদ্ধযাত্রা। কখনো খাদ্য মন্ত্রনালয়ে বাংলার মানুষকে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে, কখনো রেলওয়েকে লুটেদের হাত থেকে রক্ষা করতে কিংবা কখনো  বাংলার মানুষের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা অর্থ বিকাশ প্রতারকদের হাত থেকে রক্ষা করতে তিনি নিয়েছিলেন যুগান্তকারী উদ্যোগ।

কর্মজীবনের পাশাপাশি ব্যাক্তি জীবনেও তিনি অনন্য দৃষ্টান্তের অধিকারী যা আদর্শ ব্যাক্তিত্ব স্থাপনে অনুসরনীয়। এমনি এক ব্যাক্তি জীবনের গল্প তিনি শেয়ার করেছেন তিনি তাঁর সামাজিক মাধ্যম ফেসবুক প্রোফাইলে কীভাবে একজন সিনেমাপ্রেমী থেকে তিনি হয়েছেন আজকের মিলন স্যার; যা পাঠকদের সার্থে হুবহু তুলে ধরা হলো:

ফেসবুক পোস্ট
“ছোট বেলায় বাসার বাজার করার প্রতি প্রচুর আগ্রহ ছিল আমার। এমনকি আমার সাড়ে তিন বছরের ছোট একমাত্র ভাইটি বাজার করার বয়স অর্জন করার পরেও সে যেন এই গুরু দায়িত্ব না পায় তার জন্য সকল চেষ্টা অব্যাহত ছিল আমার। বড় ভাই থাকতে ছোট ভাই বাজার করার মত কঠিন কাজ কেন করবে!! বাবা মা খুবই খুশি ছিলেন আমার উপর, এই বোধের জন্য।
ঈদের আগে সে দায়িত্ব আরো বেড়ে যেত, সাথে ফ্রিকুয়েন্সি। হ্যাঁ! ছোটবেলা থেকেই অতি ভাল ছেলে ছিলাম আমি। বাজার শেষে প্রাপ্য কমিশন কেটে রেখে অবশিষ্ট অংশটুকু ফেরত দিতাম। বাবা মা কোন দিন একবারও জিজ্ঞাসা করেননি বা সন্দেহ পোষণ করেননি তাতে। এত ভাল ছেলেকে সন্দেহ করা, কোন ভাল বাবা মায়ের জন্য কাঙ্ক্ষিত নয়।
দুই টাকা কমিশন মানে বিশাল কিছু ছিল সে যুগে। চার আনা দিয়ে দুটি বড় পরাটা এবং এক বাটি ভাজি পাওয়া যেত। এক টাকায় ৮টি ডিম কিনেছি অনেকদিন। যা বলছিলাম, ঈদের আগের কমিশনটা হত বেশ ভাল রকমের। সিনেমা মাস্ট, ঘুড়ি-লাটাই, মার্বেল, খাওয়া দাওয়া অনেক কিছু। সে সময় স্কুল এবং স্যারের কাছে টিউশন ফাঁকি দিয়ে প্রতি সপ্তাহে মর্নিং শো দেখতাম। তার আগে বলে নেই, সিনেমা বা মর্নিং শোতে কিন্তু ইংলিশ সিনেমা দেখানো হত এবং তা ছিল খুব ভাল ভাল মুভি। কাউবয়, গ্রীক কাহিনী নিয়ে অসংখ্য সিনেমা দেখেছি আমরা।
সিনেমা দেখার এত নেশা ছিল যে, একবার শবে-বরাতের বন্ধের দিন চট্টগ্রামের আলমাস সিনেমা হলে গিয়ে দেখি হল বন্ধ। মনে খুব কষ্ট নিয়ে ফিরে এলাম বাসায়। মা জিজ্ঞাসা করলেন, কিরে স্যার পড়ায়নি? কেননা যাবার সময় বলে গিয়েছিলাম, আজ বন্ধেও স্যার পড়াবে।
ছেলের প্রচন্ড পড়ার আগ্রহ দেখে বাবা সাইকেল কিনে দিলেন। আগ্রাবাদ কলোনীর পাশে জাম্বুরী মাঠে আমার দুই বিশ্বস্ত বন্ধু মনা আর ইমরুল দুই পাশে সাইকেল ধরে থাকত, আমি চালানো শিখতে লাগলাম। বিনিময়ে ওরা কিছু সময় সাইকেল চালানোর সুযোগ পেত। দ্রুত শিখে নিলাম সাইকেল চালানো। কারণ হলে যাবার ফ্রিকুয়েন্সি আর গতিও তো বাড়াতে হবে।
শেখার পর তথাকথিত পড়ার নামে সিনেমা হল দর্শন বেড়ে গেল অনেকগুণে। বাজারের কমিশনও (টাকা মেরে দেয়া) পাল্লা দিয়ে বেড়ে যেতে লাগল। আমার পড়তে যাওয়াও ডাবল হল। এক আসল পড়া, দুই সিনেমা হল পড়া। প্রচণ্ড রোদে সাইকেল চালিয়ে সিনেমা হল থেকে ফিরে বাসায় এসে এমন ভান করতাম যে, আমি শেষ!! আজ খুব পড়ার চাপ ছিল। মা কপালের ঘাম মুছে দিতেন, সাথে লেবুর শরবত।
একদিন, হ্যাঁ সেই একদিনটা কবে কখন সেটা আর মনে নেই। মা পরম যত্নে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ঘাম মুছে দিচ্ছেন, এক হাতে ধরে আছে শরবত। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মাথাটা ঘুরে গেল আমার।
বাবা মাকে এতবড় ধোকা দিচ্ছি !!! যে বাবা মা এত বিশ্বাস রাখেন আমার উপর। কখনো পয়সার হিসেব চাননি, কোথায় গেলাম, সেটা কোন দিন যাচাই করেননি। সেই বাবা মায়ের সাথে মিথ্যা বলে চলেছি। সেটাই ছিল আমার টার্নিং পয়েন্ট। প্রতিজ্ঞা করলাম। এরপর আর কখনো মিথ্যা বলিনি, এক পয়সা কারো আমানতের খেয়ানত করিনি। আমার কাছে চুল পরিমান বিশ্বাসের মূল্য এখন জীবনের চেয়েও বেশি। আলহামদুলিল্লাহ। জানি না কি কারণে আল্লাহপাক আমায় সেদিন হেদায়েত দান করেছিলেন।
বাবার বয়স ৮২+, একেবারেই শয্যাশায়ী। মায়ের শরীরও ভাল নয়। আজ পর্যন্ত তাঁরা আমার কাছে কখনো হিসেব নেননি। জানতে চাননি, আমি বেতন কত পাই। চাকুরিতে জয়েনিং এর আগে শুধু বলেছিলেন, খবরদার এক পয়সা হারাম নিয়ে কখনো ঘরে আসবে না।”
মাহবুব কবির মিলন স্যার
অতিরিক্ত সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয়
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
এভাবেই তিনি তাঁর বাস্তব জীবনের গল্প তুলে ধরেন। পাশাপাশি তিনি অনাগত ও ভবিষ্যত প্রজন্মের উদ্দেশ্যে উপদেশ দিতে যেয়ে বলেন, “হে আমাদের ভবিষ্যৎ সন্তানেরা, হতাশ হবার কিছু নেই। ফিরে এসো সত্য আর বিশ্বাসের পথে। আমরা হয়ত পারিনি, আমরা আসহায়। আমাদের আগলে রাখো। বিশ্বাস ভঙ্গ করো না পিতা মাতার, স্বাধীনতার, লাল সবুজ পতাকার, এই মাটির। জীবন দিয়ে হলেও সত্যের মশাল ধরে রাখো।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *