চিকিৎসকের আদেশে দেওঘরে এসেছিলাম বায়ু পরিবর্তনের জন্যে। বায়ু পরিবর্তনে সাধারণত যা হয়, সেও লােকে জানে, আবার আসেও। আমিও এসেছি। প্রাচীর ঘেরা বাগানের মধ্যে একটা বড় বাড়িতে থাকি। রাত্রি তিনটে থেকে কাছে কোথাও একজন গলাভাঙা একঘেয়ে সুরে ভজন শুরু করে, ঘুম ভেঙে যায়, দোর খুলে বারান্দায় এসে বসি। ধীরে ধীরে রাত্রি শেষ হয়ে আসে- পাখিদের আনাগােনা শুরু হয়। দেখতাম ওদের মধ্যে সবচেয়ে ভােরে ওঠে দোয়েল। অন্ধকার শেষ না হতেই তাদের গান আরম্ভ হয়, তারপরে একটি দুটি করে আসতে থাকে বুলবুলি, শ্যামা, শালিক, টুনটুনি-পাশের বাড়ির আমগাছে, এ বাড়ির বকুল-কুঞ্জে, পথের ধারের অশ্বথগাছের মাথায় সকলকে চোখে দেখতে পেতাম না, কিন্তু প্রতিদিন ডাক শােনার অভ্যাসে মনে হতাে যেন ওদের প্রত্যেককেই চিনি। হলদে রঙের একজোড়া বেনে-বৌ পাখি একটু দেরি করে আসত। প্রাচীরের ধারের ইউক্যালিপটাস গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালটায় বসে তারা প্রত্যহ হাজিরা হেঁকে যেত। হঠাৎ কী জানি কেন দিন-দুই এলাে না দেখে ব্যস্ত হয়ে উঠলাম, কেউ ধরলে না তাে? এদেশে ব্যাধের অভাব নেই, পাখি চালান দেওয়াই তাদের ব্যবসা কিন্তু তিন দিনের দিন আবার দুটিকে ফিরে আসতে দেখে মনে হলাে যেন সত্যিকার একটা ভাবনা ঘুচে গেল।
এমনি করে সকাল কাটে। বিকালে গেটের বাইরে পথের ধারে এসে বসি। নিজের সামর্থ্য নেই বেড়াবার, যাদের আছে তাদের প্রতি চেয়ে চেয়ে দেখি। দেখতাম মধ্যবিত্ত গৃহস্থের ঘরে পীড়িতদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যাই ঢের বেশি। প্রথমেই যেত পা ফুলে-ফুলাে অল্পবয়সী একদল মেয়ে। বুঝতাম এরা বেরিবেরির আসামি। ফোলা পায়ের লজ্জা ঢাকতে বেচারাদের কত না যত্ন। মােজা পরার দিন নয়, গরম পড়েছে, তবু দেখি কারও পায়ে আঁট করে মােজা পরা। কেউ বা দেখলাম মাটি পর্যন্ত লুটিয়ে কাপড় পরেছে সেটা পথ চলার বিঘ্ন, তবু, কৌতুহলী লােকচক্ষু থেকে তারা বিকৃতিটা আড়াল রাখতে চায়। আর সবচেয়ে দুঃখ হতাে আমার একটি দরিদ্র ঘরের মেয়েকে দেখে। সে একলা যেত। সঙ্গে আত্মীয়-স্বজন নেই, শুধু তিনটি ছােট ছােট ছেলেমেয়ে। বয়স বােধ করি চব্বিশ-পঁচিশ, কিন্তু দেহ যেমন শীর্ণ, মুখ তেমনি পাণ্ডুর-কোথাও যেন এতটুকু রক্ত নেই। শক্তি নেই নিজের দেহটাকে টানবার, সবচেয়ে ছােট ছেলেটি তার কোলে। সে ভাে আর হাঁটতে পারে না অথচ, ফিরে আসবারও ঠাই নেই? কী ক্লান্তই না মেয়েটির চোখের চাহনি।