Saturday, December 2, 2023
গল্প রাহেলার মা: নুর-এ আফরোজ সাবা

রাহেলার মা: নুর-এ আফরোজ সাবা

-

গেরিলা অপারেশনে অংশগ্রহণ, সংবাদ আদান-প্রদান, সাংস্কৃতিক প্রণোদনা, অর্থ-ওষুধ-খাদ্য-বস্ত্র সংগ্রহ, চিকিৎসা ও সেবাকার্য, খাদ্য ও আশ্রয়দান ইত্যাদি সব কাজই মুক্তিযুদ্ধে সাফল্য অর্জনে ভূমিকা রেখেছে নারী। তেমনি এক নারী বীরাঙ্গনার গল্প নিয়ে এসেছে জয়দেবপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী নূর-এ আফরোজ সাবা….

রাহেলার মা

মিসেস রাহেলা মুহীনের আজ হঠাৎ  মায়ের কথা মনে পড়ে গেল। আজ প্রায় ৫০ বছর হয়ে গেল, কই কোনদিনও তো এতো মন খারাপ হয়নি। মায়ের মন খারাপ দেখে সর্বপ্রথম প্রশ্ন করল তার ছোট মেয়ে ইতি, “মা, কি হয়েছে? কলেজ  থেকে যখন ফিরেছি তখন থেকেই দেখতেছি তোমার মন খারাপ। “।রাহেলা কিছু বলার আগেই কলিং বেল বেজে উঠলো। রাহেলার বড় মেয়ে শ্রুতি ভার্সিটি থেকে ফিরেছে। ইতির মতো সেও একই জিনিস খেয়াল করলো।এই একই প্রশ্ন করল।রাহেলা বলল  ,” আজ কেন জানি তোদের নানীর কথা মনে পড়ছে।” ইতি বলল, “মা, শুনেছি নানু একাত্তরের যুদ্ধে মারা গেছে?”রাহেলা নিশ্বাস ফেলে বলল , “হ্যাঁ রে মা।” শ্রুতি বলল,”কিভাবে মারা গিয়েছিল নানু?”রাহেলা  বলল, “শুনবি? ”   ইতি লাফিয়ে উঠে বলল,”তোমার এখনো মনে আছে !”রাহেলা বলল, “সেই ভয়ানক স্মৃতি কি  ভুলে যেতে পারি।আমার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব স্পষ্ট মনে আছে।” শ্রুতি বলল,” বল তাহলে।” রাহেলা শুরু করলো:

“১৯৭১ সালের ২৪শে এপ্রিল। আমার বয়স তখন ৫ বছর। আমাদের গ্রামের নাম অতুলমান গ্রাম।কারণ, অতুল নদী আমাদের গ্রামের মধ্যে দিয়ে বইত। বাবা আমার জন্মের আগেই মারা গিয়েছিল।  মা আমার নানাকে বলল,”আব্বা,হক্কলে যুদ্দে  গ্যাছে।এমুনকি আমাগোর পাশের বাড়ির  মনিরুল ভাইও গ্যাছে।  আমিও যামু।” নানা কড়াকড়ি বললেন,”ওডি পোলাগো কাম। তুই ক্যামনে যাবি? তুই ঘরের কাম কর আর রাহেলারে সামলা। ওগুলাই তর কাম।” বলে নানা চলে গেল ঘুমুতে। আমি আর মাও শুতে গেলাম। রাত বোধ হয় তখন ২টা বাজে।আমি আর মা দরজার ঠকঠকানির শব্দে আমরা জেগে উঠি।মা আঁতকে উঠে বলল,”সব্বনাশ,মিলিটারি আইল নাকি?কিন্তু হ্যারা এত্তু আস্তে ধাক্কাইব ক্যান? যাই হউক,  রাহেলা মা রে তুই খাডের তলায় গিয়া টেরাংকের ভিতরে ডুইকা যা।আমাগোর ছিন্তা করবি না।” আমি মায়ের কথামতো নিচে  গেলাম। মা দরজা খুলল।ট্রাংকের দোরের ফাঁক থেকে দেখলাম দুজন লোক। একজনের শার্ট সাদার ওপরে লাল চেক আর অন্যজনের নীল। হঠাৎ দেখলাম ওরা দুটো রাইফেল পিঠ থেকে নামিয়ে মাটিতে রাখলো নিজের অজান্তেই “ইইই”এরকম একটা  শব্দ করে ফেললাম। তারা টের পেয়ে নিচে আমায় খুঁজতে । মা আমায় বলল,”বাইর হ রে।এ্যরা হেই মানুষ না।” আমি বের হয়ে এলাম। লোক দুটোর মধ্যে একজন বলল,”এমা! তুমি খাটের তলায় কি করতাছ?” মা বলল,”ভাবছিলাম মিলিটারি আইছে।তাই আরকি……  ” ওরা একটু  ভাত খেলো আর একটা কাগজে মায়ের কথামতো কি যেন লিখলো আর চলে গেল।। মা হঠাৎ আমায় কোলে নিয়ে বলল,”মা রে আমি আমি যুদ্দে যামু। আমি ফিইররা আমু কিনা জানিনা।তুই তর নানা -নানি আর খালার লগে থাকিস।উনাগো জালাবি না।ভালো থাকিস। “এই বলে মা আমাকে বুকে চেপে ধরে আর একটু দোলনা দুলুনি দিলো

আর আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে প্রচণ্ড কোলাহলে ঘুম ভাঙলো।নানি কাঁদছে। নানা সামনে অনেক লোকের (প্রায় দশ পনেরো জন) সাথে কথা বলছিল।খালা খুব টেনশনে ছিলো। আমি ঘটনা বুঝতে না পেরে মাকে জিজ্ঞাসা করার জন্য ওদিকে ফিরলাম। ফিরে যা দেখলাম তা দেখে আমিও কাঁদোকাঁদো গলায় জিজ্ঞাসা করলাম,”মা কই?”এতক্ষণ পর সবাই টের পেল আমি উঠে গেছি। সর্বপ্রথম খালা দৌড়ে এসে বলল, “কালকে রাতে কি হয়েছিলো,জানিস ?” আমি সব বললাম সবাইকে । শুনে নানা বলল,”ক্যামনে যে মাইয়্যাডার মাথায় ভূতডা চাপলো। রাইতেই আমি সাহেরারে কইছিলাম এইডা মাইয়্যাগর কাম না! হুনল না!! এরপর প্রায়  ৮ মাস পর দেশ স্বাধীন হলো।মনিরুল চাচা ১৭ই ডিসেম্বর  ফিরে এলেন। ওনার একটা পা চলে গেছে।উনি ফেরার পর নানা আর আমি মায়ের খবর জানতে ওইদিন রাতেই তাঁর কাছে গেলাম।উনি আমায় দেখে কেঁদে ফেলল।এরপর আমাদের বলল,”সাহেরা আর বাইছা নাই। ও আমাগরে মিলিটারিগো খবর দিত। ১৪ই ডিসেম্বর  অতুল নদীর ক্যাম্পে অরে পাডানো অইছিল।হেইহানে ও দরা হইরা যায়।হ্যারা অরে চোখ আর হাত বাইন্ধা হাটু গাইরা বয়াইল আর গুলি মারল ৮ -১০ টা ।এরপর অর লাশ অতুল নদীতে ফালায়া দিল।নানা আর আমি বাড়ি ফিরলাম। নানা বলল আমি আমার খালার সাথে ঢাকায় পড়তে যাব।  ১৮ই ডিসেম্বর খবর পাওয়া গেল মায়ের লাশ পাওয়া গেছে।এরপর মায়ের দাফন কাজ শেষ হওয়ার পর,আমাকে খালার সাথে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়া হলো।”রাহেলা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।খেয়াল করলেন, ইতি ও শ্রুতির চোখে জল এসে গিয়েছে।তিনি দেখেও না দেখার ভান করে রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলেন। শ্রুতি  ইতিকে  বলল, দেশ স্বাধীন হওয়ার পিছনে পুরুষদের যতটুকু অবদান মহিলাদের তার চেয়ে কোনো অংশে কম না যা নানু প্রমাণ করে দিয়েছে।আসলে সমাজের মনে একটা ধারণা বসে গেছে যে মেয়েরা ঘরের কাজের জন্য জন্মেছে।এ ধারণা যতদিন না মুছবে ততদিন পর্যন্ত নানুর এই ত্যাগ সার্থক হবে না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Latest news

What Is a Virtual Info Room?

A electronic data space (VDR) is mostly a secure on the web repository for the purpose of sharing...

Benefits of Board Room Software

A plank room applications are a digital meeting space that enables you to operate together...

Management Software is an important Tool for the purpose of Sensitive Govt Files

Government agencies are often times overwhelmed by sheer amount of conventional paper they handle, from applications to accounts...

Can be 360 Secureness Legit?

The answer to the problem “is fish hunter 360 security legit” is yes, although it’s...

How to Protect the Personal Data That’s Most Important to you personally

Every day, all of us create a digital footprint by simply sharing information concerning social media, filling out...

Asus Gaming Notebook computers

If you're in the market for a games laptop, there are plenty of excellent alternatives out there. The...

Must read

What Is a Virtual Info Room?

A electronic data space (VDR) is mostly a...

Benefits of Board Room Software

A plank room applications are a digital meeting...

লেখা আহবান

বহুল প্রচলিত মাসিক পত্রিকায় আপনার লেখা জমা দিন

পছন্দনীয় আরোও খবর: